¤
Test
ssahor
Holodpisach
Devi
Jgolposkln
Sorongobondi
Kingmetho
Alibaba
Fivehorrorgolpo
SraniDrani
Hozobarolo
Aboxbhot
Gbhot
Hadith
HJokes
Davdas
মতিচূর ১
Hottakari

বইঃ মতিচুর (প্রথম খন্ড)

লেখিকাঃ বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

¤
||নিবেদন||
মতিচূরের কোন কোন পাঠকের সমালোচনায় জানা যায় যে তাঁহারা মনে করেন,মতিচূরের ভাব ও ভাষা অন্যান্য খ্যাতনামা গ্রন্থকারদের গ্রন্থ হইতে গৃহীত হইয়াছে। পূর্ববর্ত্তী কোন কোন পুস্তকের সহিত মতিচূরের সাদৃশ্য দর্শনে পাঠকদের ওরূপ প্রতীতি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অপরের ভাব কিম্বা ভাষা স্বায়ত্ত করিতে যে সাহস ওনিপুণতার প্রয়োজন, তাহা আমার নাই; সুতরাং তাদৃশ্যচেষ্টা আমার পক্ষে অসম্ভব। (কালীপ্রসন্নবাবুর “ভ্রান্তিবিনোদ” আমি অদ্যাপি দেখি নাই এবং বঙ্কিমবাবুর সমুদয় গ্রন্থ পাঠের সুযোগও প্রাপ্ত হই নাই। যদি অপর কোন গ্রন্থের সহি মতিচূরের সাদৃশ্য ঘটিয়া থাকে, তাহা সম্পূর্ণ দৈব ঘটনা।) আমিও কোন উর্দ্দু মাসিক পত্রিকায় কতিপয় প্রবন্ধ দেখিয়া চমৎকৃত হইয়াছি-উক্ত প্রবন্ধাবলীর অনেক অংশ মতিচূরের অবিকল অনুবাদ বলিয়া ভ্রম জন্মে। কিন্তু আমার বিশ্বাস সে প্রবন্ধসমূহের লেখিকাগণ বঙ্গভাষায় অনভিজ্ঞা। ইংরাজ মহিলা মেরী করেলীর “ডেলিশিয়া হত্যা” (The murder of Delicia) উপন্যাস খানি মতিচূর রচনার পূর্বে আমার দৃষ্টিগোচর হই নাই, অথচ অংশবিশেষের ভাবের সহিত মতিচূরের ভাবের ঐক্য দেখা যায়। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, কেন এরূপ হয়? বঙ্গদেশ, পঞ্জাব, ডেকান (হায়দরাবাদ), বোম্বাই, ইংলন্ড-সর্বত্র হইতে একইভাবের উচ্ছ্বাস উত্থিত হয় কেন? তদুত্তরে বলা যাইতে পারে, ইহার কারণ সম্ভবতঃ ব্রিটীশ সাম্রাজ্যের অবলাবৃন্দের আধ্যাত্মিক একতা!কতিপয় সহৃদয় পাঠক মতিচূরে লিখিত ইংরাজী শব্দ ও পদের বাঙ্গালা অর্থ না লেখার ত্রুটী প্রদর্শন করিয়াছেন। এবারযথাসম্ভব ইংরাজী শব্দসমূহের মর্ম্মানুবাদ প্রদত্ত হইল। যাঁহারা মতিচূরে যে কোন ভ্রম দেখাইয়া দিয়াছেন, তাঁহাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ আছি। মতিচূরে আর যে সকল ত্রুটীআছে, তাহার কারল লেখিকার বিদ্যা-বুদ্ধির দৈন্য এবং বহুদর্শিতার অভাব। গুণগ্রাহী পাঠক পাঠিকাগণতাহা মার্জ্জনা করিবেন, এরূপ আশা করা যায়। বিনীতা গ্রন্থকর্ত্র।
||পিপাসা(মহরম)||
কা’ল বলেছিলে প্রিয়! আমারে বিদায় দিবে, কিন্তু নিলে আজ আপনি বিদায়! * দুঃখ শুধু এই-ছেড়ে গেলে অভাগায় ডুবাইয়া চির তরে চির পিপাসায়! যখন যেদিকে চাই, কেবলি দেখিতে পাই,- “পিপাসা, পিপাসা” লেখা জ্বলন্ত ভাষায়। শ্রবণে কে যে ঐ “পিপাসা” বাজায়। প্রাণটা সত্যই নিদারুণ তৃষানলে জ্বলিতেছে। এ জ্বালার শেষ নাই, বিরাম নাই, এ জ্বালা অনন্ত। এ তাপদগ্ধ প্রাণ যে দিকে দৃষ্টিপাত করে, সেই দিকে নিজের হৃদয়ের প্রতিবিম্বদেখিতে পায়। পোড়া চ েআর কিছুই দেখি না। পুস্পময়ী শস্যশ্যামলা ধরণীর আনন্দময়ী মূর্ত্তি আমি দেখি না। বিশ্ব জগতের মনোরম সৌন্দর্য আমি দেখি না। আমি কি দেখি, শুনিবে? যদি হৃদয়ে ফটোগ্রাফ্‌ তোলা যাইত, যদি চিত্রকরের তুলিতে হৃদয়ের প্রতিকৃতি অঙ্কিতকরিবার শক্তি থাকিত,-তবে দেখাইতে পারিতাম, এ হৃদয় কেমন! কিন্তু সে উপায় নাই। ঐ যে মহরমের নিশান, তাজিয়া প্রভৃতি দেখা যায়,-ঢাক ঢোল বাজে, লোকে ছুটাছুটি করে, ইহাইকি মহরম? ইহাতে কেবল খেলা, চর্ম্মচক্ষে দেখিবার তামাসা। ইহাকে কে বলে মহরম? মহরম তবে কি? কি জানি, ঠিক উত্তর দিতে পারিলাম না। কথাটা ভাবিতেই পারি না,-ওকথা মনে উদয় হইলেই আমি কেমন হইয়া যাই,-চক্ষে অন্ধকার দেখি, মাথা ঘুরিতে থাকে! সুতরাং বলিতে পারি না-মহরম কি!আচ্ছা তাহাই হউক, ঐ নিশানতাজিয়া লইয়া খেলাই হউক; কিন্তু ঐ দৃশ্য কি একটা পুরাতন শোকস্মৃতি জাগাইয়া দেয় না? বায়ু-হিল্লোলে নিশানের কাপড় আন্দোলিত হইলে, তাহাতে কি স্পষ্ট লেখা দেখা যায় না-“পিপাসা”? উহাতে কি একটা হৃদয়-বিদারক শোকস্মৃতি জাগিয়া উঠে না? সকল মানুষই মরে বটে-কিন্তু এমন মরণ কাহার হয়? একদিন স্বপ্নে দেখিলাম-স্বপ্নে মাত্র যেন সেই কারবালায় গিয়াছি। ভীষণ মরুভূমি তপ্ত বালুকা; চারিদিক ধূ ধূ করিতেছে; সমীরণ হায় হায় বলিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, যেন কাহাকে খুঁজিতেছে! আমি কেবল শুনিতে পাইলাম-“পিপাসা, পিপাসা”! বালুকাকণায় অঙ্কিত যেন “পিপাসা,পিপাসা”! চতুর্দ্দিক চাহিয়া দেখিলাম, সব শূন্য, তাহার ভিতর “পিপাসা” মূর্ত্তিমতী হইয়া ভাসিতেছে! সে দৃশ্য অতি ভয়ঙ্কর-তথা হইতে দূরে চলিলাম। এখানে যাহা দেখিলাম, তাহা আরও ভীষণ, আরও হৃদয়-বিদারক! দেখিলাম-মরুভূমি শোণিত-রঞ্জিত! রক্ত-প্রবাহ বহিতে পারে নাই-যেমন রক্তপাত হইয়াছে, অমনি পিপাসু মরুভূমি তাহা শুষিয়া লইয়াছে! সেই রুধির-রেখায় লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”! নবীন যুবক আলী আকবর (হোসেনের পুত্র) যুদ্ধে ক্লান্ত হইয়া পিতার নিকট পিপাসা জানাইতে আসিয়া কাতর কণ্ঠে বলিতেছেন-“আল-আৎশ! আল-আৎশ!!” (পিপাসা, পিপাসা!) ঐ দেখ, মহাত্মা হোসেন স্বীয় রসনা পুত্রকে চুষিতে দিলেন, যদি ইহাতে তাঁহার কিছুমাত্র তৃপ্তি হয়! কিন্তু তৃপ্তি হইবে কি,-সে রসনা যে শুঙ্ক-নিতান্ত শুঙ্ক! যেন দিক দিগন্তর হইতে শব্দ আসিল,-“পিপাসা পিপাসা”! মহাত্মা হোসেন শিশুপুত্র আলী আসগরকে কোলে লইয়া জল প্রার্থনা করিতেছেন! তাঁহার কথা কে শুনে? তিনি দীন নয়নে আকাশপানে চাহিলেন,-আকাশ মেঘশূন্য নির্ম্মল,-নিতান্তই নির্ম্মল! তিনি নিজের কষ্ট,-জল পিপাসা অম্লান বদনে সহিতেছেন। পরিজনকে সান্ত্বনা বাক্যে প্রবোধ দিয়াছেন। সকিনা প্রভৃতি বালিকারা জল চাহে না-তাহারা বুঝে, জল দুস্প্রাপ্য। কিন্তু আসগর বুঝে না-সে দুগ্ধপোষ্য শিশু, নিতান্ত অজ্ঞান। অনাহারেজলাভাবে মাতার স্তন্য শুকাইয়া গিয়াছে-শিশু পিপাসায় কাতর।
শহরবানু (হোসেনের স্ত্রী) অনেক যন্ত্রণা নীরবে সহিয়াছেন-আজ আসগরের যাতনা তাঁহার অসহ্য! তিনি অনেক বিনয় করিয়া হোসেনের কোলে শিশুকে দিয়া জল পার্থনা করিতে অনুরোধ করিলেন। বলিলেন,-“আর কেহ জল চাহে না; কেবল এই শিশুকে একটু জল পান করাইয়া আন। শক্র যেন ইহাকে নিজ হাতে জল পান করায়,-জলপাত্রটা যেন তোমার হাতে নাই দেয়!!” মহাত্মা হোসেন স্ত্রীর কাতরতা এবং শিশুর দুরবস্থা দেখিয়া জল প্রার্থনা করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কাতরস্বরে বলিলেন, “আমি বিদেশী পথিক, তোমাদের অতিথি, আমার প্রতি যত ইচ্ছা অত্যাচার কর, সহিতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু এ শিশু তোমাদের নিকট কোন দোষে দোষী নহে। পিপাসায় ইহার প্রাণ ওষ্ঠাগত-একবিন্দু জল দাও! ইহাতে তোমাদের দয়াধর্ম্মের কিছুমাত্র অপব্যয় হইবে না!” শক্রগণ কহিল, “বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভকরিয়াছে,-শীঘ্র কিছু দিয়া বিদায় কর।” বিপক্ষ হইতে শিশুর প্রতি জলের পরিবর্ত্তে তীর বৃষ্টি হইল!! “পিয়াস লাগিয়া জলদে সাধিনু বজর পড়িয়া গেল।” উপযুক্ত অতিথি-অভ্যর্থনাবটে! হোসেন শর-বিদ্ধ আসগরকে তাহার জননীর কোলে দিয়া বলিলেন, “আসগরচিরদিনের জন্য তৃপ্ত হইয়াছে! আর জল জল বলিয়া কাঁদিয়া কাঁদাইবে না! আর বলিবে না-‘পিপাসা, পিপাসা’! এই শেষ!” * শহরবানু কি দেখিতেছেন? কোলে পিপাসু শর-বিদ্ধ আসগর, সম্মুখে রুধিরাক্ত কলেবর “শহীদ” (সমরশায়ী) আকবর! অমন চাঁদ কোলে লইয়া ধরণী গরবিণী হইয়াছিল-যে আকবর ক্ষতবিক্ষত হইয়া, পিপাসায় কাতর হইয়া মৃত্যুকালে এক বিন্দু জল পায় নাই। শোণিত-ধারায় যেন লেখা আছে “পিপাসা, পিপাসা”! শহীদের মুদ্রিতনয়ন দুটি নীরবেই বলে যেন “পিপাসা, পিপাসা”!! দৃশ্যত এইরূপ মর্ম্মভেদী তাহাতে আবার দর্শক জননী!-আহা!! যে ফুল ফুটিত প্রাতে,-নিশীথেই ছিন্ন হ’ল, শিশিরের পরিবর্ত্তে রুধিরে আপ্লুত হ’ল! আরও দেখিলাম,-মহাত্মা হোসেন সমরশায়ী। সমরক্ষেত্রে কেবলই পিপাসী শহীদগণ পড়িয়া আছেন।
তাঁহাদের শুঙ্ক কণ্ঠ যেন অস্ফুট ভাষায় বলিতেছে “পিপাসা, পিপাসা”! জয়নব (হোসেনর ভগিনী) মুক্ত কেশে পাগলিনী প্রায় ভ্রাতার নিকট বিদায় চাহিতেছেন। ডাকিয়া, উচ্চৈঃস্বরে ডাকিয়া বলিতেছেন,-“ভাই! তোমাকে মরুভূমে ফেলিয়া যাইতেছি! আসিয়াছিলাম তোমার সঙ্গে,-যাইতেছি তোমাকে ছাড়িয়া! আসিয়াছিলাম অনেক রত্নে বিভূষিত হইয়া-যাইতেছি শূন্য হৃদয়ে! তবে এখন শেষবিদায় দাও! একটি কথা কও, তবে যাই! একটিবার চক্ষু মেলিয়া দেখ-আমাদের দুরবস্থা দেখ, তবে যাই!” জয়নবের দুঃখে সমীরণ হায় হায় বলিল,-দূর দূরান্তরে ঐ হায় হায় শব্দ প্রতিধ্বনিত হইল! * এখন আর স্বপ্ন নাই-আমি জাগিয়া উঠিয়াছি। দূরে শৃগালের কর্কশ শব্দে শুনিলাম-“পিপাসা, পিপাসা”! একি, আমি পাগল হইলাম নাকি? কেবল “পিপাসা” দেখি কেন। কেবল “পিপাসা” শুনি কেন? আমার প্রিয়তমের সমাধিস্থানে যাইলাম। বনপথ দিয়া যাইতে শুনিলাম,তরুলতা বলে “পিপাসা, পিপাসা”! পুত্রে মর্ম্মরশব্দে শুনিলাম “পিপাসা, পিপাসা”! প্রিয়তমের গোরহইতে শব্দ আসিতেছিল-“পিপাসা, পিপাসা”! ইহা অতি অসহ্য! প্রিয়তম মৃত্যুকালে জল পায় নাই-চিকিৎসরে নিষেধ ছিল।সুতরাং পিপাসী মরিয়াছে। আহা! এমন ডাক্তারী কে রচনা করিয়াছেন? রোগীর প্রতি (রোগ বিশেষে) জল-নিষেধ ব্যবস্থা কোন হৃদয়হীন পাষাণের বিধান? যখন রোগীকে বাঁচাইতে না পার, তখন প্রাণ ভরিয়া পিপাসা মিটাইয়া জল পান করিতে দিও। সে সময় ডাক্তারের উপদেশ শুনিও না। নচেৎ আমারই মত আজীবন পিপাসায় দগ্ধ হইবে। কোন রোগী মৃত্যুর পূর্বদিন বলিয়াছিল, “বাবাজ্বান! তোমারই সোরাহির জল অবশ্যই শীতল হইবে। পিতা তাহার আসন্নকাল জানিয়া স্বহস্তে সোরাহি আনিয়া দিলেন। অন্যান্য মিত্ররূপী শক্রগণ তাহাকেপ্রচুর জল সাধ মিটাইয়া পান করিতে দেয় নাই। ঐ রোগীর আত্মা কি আজ পর্যন্ত কারবালার শহীদদের মত “পিপাসা, পিপাসা” বলিয়া ঘুরিয়া বেড়ায় না? না; স্বর্গসুখেপিপাসা নাই! পিপাসা-যে বাঁচিয়া থাকে,-তাহারই!অনন্ত শান্তি নিদ্রায় যে নিদ্রিত হইয়াছে, পিপাসা তাহার নহে! পিপাসা-যে পোড়া স্মৃতি লইয়া জাগিয়া থাকে,-তাহারই!! কিন্তু কি বলিতে কি বলিতেছি,-আমার হৃদয়ানন্দমৃত্যুর পূর্বদিন গোপনেজননীর নিকট জল চাহিয়াছিল। ডাক্তারের নিষেধ ছিল বলিয়া কেহ তাহাকে জল দিত না। জননী ভয়ে ভয়ে অল্প জল দিয়াছিলেন। মৃত্যুকালে সে তৃষ্ণায় অত্যন্ত কাতর ও অধীর হইয়াছিল-হায়! না জানি সে কেমন পিপাসা! হৃদয়ানন্দ জানিত, আমি তাহাকে জল দিব না। আমি চিকিৎসকের অন্ধ আজ্ঞাবহ দাস, তাহাকে জল দিব না। তাই সে আমার উপস্থিত থাকাসময় জল চাহিতে সাহস করে নাই! কি মহতী সহিষ্ণুতা! জলের পরিবর্ত্তে চা চাহিল। শীতল জলের পিপাসায় গরম চা!! চা তখনই প্রস্তুত হইয়া আসিল। যে ব্যক্তি চা পান করাইতেছিল, সে চার পেয়ালার কড়া ধরিতে পারিতেছিল না-পেয়ালা এত তপ্ত ছিল। আর সেই পিপাসী সে পেয়ালাটি দুই হস্তে (যেন কত আদরের সহিত জড়াইয়া) ধরিয়া চা পান করিতে লাগিল!! আহা! না জানি সে কেমন পিপাসা!! অনলরচিত পিপাসা!! কিম্বা গরলরচিত পিপাসা!!সে সময় হয় ত তাহার শরীরে অনুভব শক্তি ছিল না,-নচেৎঅত গরম পেয়ালা ও কোমল হস্তে সহিবে কেন? আট বৎসরের শিশু-ননীর পুতুল, তাহার হাতে গরম পেয়ালা!-আর সেই তপ্ত চা-স্বাস্থ্য ভাল থাকিলেনিশ্চয় গলায় ফোস্কা হইত! আর ঐ মাখন-গঠিত কচি হাত দুটি জ্বলিয়া গলিয়া যাইত!! সেই চা তাহার শেষ পথ্য-আর কিছু খায় নাই। আক্ষেপ এই যে, জল কেন দিলাম না। রোগ সারিবার আশায় জল দিতাম না।- রোগ যদি না সারিল, তবে জল কেন দিলাম না? এই জন্যই ত রাত্রি দিন শুনি,-“পিপাসা, পিপাসা”! ঐ জন্যই ত এ নরকযন্ত্রণা ভোগ করি। আর সেই গরম চা’র পেয়ালা চরে সম্মুখে ঘুরিয়া বেড়ায়, হৃদয়ে আঘাতকরে, প্রাণ দগ্ধ করে! চক্ষু মুদ্রিত করিলে দেখি-অন্ধকারে জ্যোতির্স্ময় অরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”! নিশীথ সময়ে গৃহছাদে উঠিলাম। আকাশমণ্ডল পরিস্আরর ছিল কোটী কোটী তারকা ও চন্দ্র হীরক প্রভায় জ্বলিতেছিল।আমার পোড়া চক্ষে দেখিলাম-ঐ তারকা-অরে লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”! আমি নিজের পিপাসা লইয়া ব্যস্ত, তাহাতে আবার বিশ্বচরাচর পিপাসা দেখায়-পিপাসা শুনায়! বোধ হয় নিজের পিপাসার প্রতিবিম্ব দেখিতে পাই মাত্র,-আর কেহ পিপাসী নহে। অথবা এ বিশ্বজগৎ সত্যিই পিপাসু! কুসুমকাননে আমি কি দেখিতে পাই? কুসুম হেলিয়া দুলিয়া বলে “পিপাসা, পিপাসা” লতায় পাতায় লেখা-“পিপাসা, পিপাসা”। কুসুমের মনোমোহিনী মৃদু হাসি আমি দেখি না। আমি দেখি, কুমুদের সুধাংশু-পিপাসা।
বিহগ-কুজনে আমি কি শুনিতে পাই? ঐ “পিপাসা, পিপাসা”! ঐ একই শব্দ নানাসুরে নানারাগে শুনি,-প্রভাতে ভৈরবী, নিশীথে বেহাগ-কিন্তু কথাএকই। চাতক পিপাসায় কাতর হইয়া ডাকে-“ফটিক জল”! কোকিল ডাকিয়া উঠে “কুহু” ঐ কুহুস্বরে শত প্রাণের বেদনা ও হৃদয়ের পিপাসা ঝরে! এ কি, সকলে আমাকে পিপাসার ভাষা শুনায় কেন? আহা! আমি কোথাই যাই? কোথায় যাইরে “পিপাসা” শুনিব না? চল হৃদয়, তবে নদী তীরে যাই,-সেইখানে হয় ত “পিপাসা” নাই। কিন্তু ঐ শুন! স্নিগ্ধসলিলা গঙ্গাকুলকুল স্বরে গাহিতেছে। “পিপাসা, পিপাসা” আপন মনেগাহিয়া বহিয়া যাইতেছে! একি তুমি স্বয়ং জল, তোমার আবার পিপাসা কেমন? উত্তর পাইলাম, “সাগর-পিপাসা”। আহা! তাই ত, সংসারে তবে সকলেই পিপাসু? হইতে পারে, সাগরের-যাহার চরণে, জাহৃবি! তুমি আপনার প্রাণ ঢালিতে যাইতেছ, তাহার পিপাসা নাই। তবে দেখা যাউক। একদিন সিন্ধু’তটে সিক্ত বালুকার উপর বসিয়া সাগরের তরঙ্গ গণনা করিতেছিলাম। ঊর্ম্মিমালা কি যেন যাতনায়, কি যেন বেদনায় ছটফট করিয়া গড়াইয়া গড়াইয়া আছাড়িয়া পড়িতেছিল। এ অস্থিরতা, এ আকুলতা কিসের জন্য? সবিস্ময়ে সাগরকে জিজ্ঞাসা করিলামঃতব এই সচঞ্চল লহরীমালায় কিসের বেদনা লেখা?-পিপাসা জানায়! পিপাসা নিবৃত্‌ হয় সলিল-কৃপায়, বল হে জলধি! তব পিপাসা কোথায়? আবার তাহার গভীর গর্জ্জনে শুনিলাম, “পিপাসা, পিপাসা”! হায়! এই পোড়া পিপাসায় জ্বালায় আমি দেশান্তরে পলাইয়া আসিলাম, এখানেও ঐ নিষ্ঠুর কথাই শুনিতে পাই। চক্ষু মুদ্রিত করিলাম-ঐ তরঙ্গে তরঙ্গে আর পিপাসা দেখিতে ইচ্ছা ছিল না। সমুদ্র আবার গম্ভীর গর্জ্জন করিল। এবারও তাহার ভাষা বুঝিলাম,-স্পষ্ট শুনিলাম,-“পিপাসা, পিপাসা।”!! “পিপাসা পিপাসা”-মুর্খ মানব! জান না এ কিসের পিপাসা? কোথায় শুনিয়াছ সাগরের পিপাসা নাই? এ হৃদয়ের দুর্দ্দান্ত পিপাসা কেমন করিয়া দেখাইব? আমার হৃদয় যত গভীর, পিপাসাও তত প্রবল! এ সংসারে কাহার পিপাসা নাই? পিপাসা পিপাসা-এইটুকু বুঝিতে পার না? ধনীর ধন-পিপাসা, মানীর মান-পিপাসা, সংসারীর সংসার-পিপাসা। নলিনীর তপন-পিপাসা, চকোরীর চন্দ্রিকা-পিপাসা! অনলেরও তীব্র পিপাসা আছে! আহা! এই মোটা কথা বুঝ না? পিপাসা না থাকিলেব্রহ্মাণ্ড ঘুরিত কি লক্ষ্য করিয়া? আমার হৃদয়ে অনন্ত প্রণয়-পিপাসা,-যতদিন আছি, পিপাসাও থাকিবে! প্রেমিকের প্রেম-পিপাসা,-প্রকৃতির ঈশ্বর পিপাসা! এইটুকু কি বুঝিতে পার না?····” তাই বটে, এত দিনে বুঝিলাম,আমার হৃদয়ে কেন সদা হু হুকরে, কেন সদা কাতর হয়। এ হৃদয়ের পিপাসা তুচ্ছ বারি পিপাসা নহে। ইহা অনন্ত প্রেম-পিপাসা। ঈশ্বর একমাত্র বাঞ্জনীয়, আর সকলে পিপাসী-ঐ বাঞ্জনীয় প্রেমময়ের প্রেম-পিপাসী!!আমি তবে বাতুল নহি। আমি যে পিপাসা দেখি, তাহা সত্য-কল্পিত নহে! আমি যে পিপাসা শুনি, তাহাও সত্য-কল্পনা নহে! ঈশ্বর প্রেম, এ বিশ্বজগৎ প্রেম-পিপাসু। ******************** ১ একদা জয়নাল আবেদীন (হোসেনের পুত্র) জনৈক কসাইকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “ছাগল জবেহ করিতে আনিয়াছ,উহাকে কিছু খাইয়াইয়াছ?” কসাই উত্তর করিল, “হ্যাঁ, ইহাকে এখনই প্রচুর জলপান করাইয়া আনিলাম!” ইহা শুনিয়া তিনি বলিলে, “তুমিছাগলটাকে প্রচুর জলপানে তৃপ্ত করিয়া জবেহ করিতে আনিয়াছ; আর শিমর আমার পিতাকে তিন দিন পর্যন্ত জলাভাবে পিপাসায় দগ্ধ করিয়া জবেহ করিয়াছে!!” কারবালার যুদ্ধের সময় জয়নাল ভুগিতেছিলেন বলিয়াশহীদ (সমরশায়ী) হয় নাই।২ ধর্মগুরু মহাত্মা মোহাম্মদের (দঃ) মৃত্যুর পর, ক্রমান্বয়ে আবুবকর সিদ্দিক, ওমর খেতাব ও ওসমান গনি “খলিফা” হইলেন। চতুর্থবারে আলী খলিফা হইবেন, কি মোয়াবীয়া খলিফা হইবেন, এই বিষয়ে মতভেদ হয়। একদল বলিল, “মোয়াবীয়া হইবেন,” একদল বলে “আলী মোহাম্মদের (দঃ) জামাতা, তিনি সিংহাসনের ন্যায্য অধিকারী”। এইরূপে বিবাদের সূত্রপাত হয়। অতঃপর মোয়াবীয়ার পুত্র এজিদ, আলীর পুত্র হাসান ওহোসেনের সর্ব্বনাশ করিতে বদ্ধপরিকর হইল। এজিদ মহাত্মা হাসানকে কৌশলে বিষ পান করাইয়া হত্যা করে। ইহার এক বৎসর পরে মহাত্মা হোসেনকে ডাকিয়া (নিয়ন্ত্রণ করিয়া) কারবালায় লইয়া গিয়া যুদ্ধে বধ করে। কেবল যুদ্ধ নহে-এজিদের দলবল ইউফ্রেতীজ নদী ঘিরিয়া রহিল; হোসেনের পরে কোন লোককে নদীর জল লইতে দেয় নাই। পানীয় জলেরঅভাবেই তাঁহারা আধমরা হইয়াছিলেন। পরে যুদ্ধের নামে একই দিন হোসেন আত্মীয়স্বজনসহ নিহত হইলেন। এ কথায় মতভেদ আছে;কেহ বলেন, তিন দিন যুদ্ধ হয়, কেহ বলেন একই দিন যুদ্ধ করিয়া সকলে সমরশায়ী হইয়াছেন। নদীর জল হইতে হোসেনকে বঞ্চিত করিয়া এজিদ অশেষ নিষ্ঠুরতা প্রকাশ করিয়াছে। অষ্টাদশ বর্ষীয় নবীন যুবক কাসেম (হাসানের পুত্র) মৃত্যুর পূর্ব্ব রাত্রে হোসেনের কন্যা সকিনাকে বিবাহ করেন! কারবালা যখন সকিনাকে নববধূ বেশে দেখিল, তাহার কয় ঘন্টা পরেই তাঁহাকে নববিধবা বেশে দেখিয়াছিল!যেদিন বিবাহ, সেই দিনই বৈধব্য! হায় কারবালা! এ দৃশ্য দেখার চেয়ে অন্ধ কেন হও নাই? পুরুষগণ ত যুদ্ধ করিতেছিলেন, আর ললনাগণ কি পাইলেন!
-কাসেমের জন্য কাঁদিতেছিলেন, আলী আকবরের মৃতদেহ পাইলেন! শোকোচ্ছ্বাস কাসেমকে ছাড়িয়া আকবরের দিকে ধাবিত হইল,-আকবরের মাথা কোলে লইয়া কাঁদিতেছিলেন, শিশু আসগরকে শর-বিদ্ধ অবস্থায়প্রাপ্ত হইলেন! এক মাতৃ-হৃদয়-আকবরকে কোল হইতে নামাইয়া আসগরকে কোলে লইল-কত সহ্য হয়? পুত্রশোকে আকুল্য আছেন,-কিছুক্ষণ পরে সর্বস্বধন হোসেনের ছিন্ন মস্তক (শক্র উপহার পাঠাইল) পাইলেন, তাই দেখিতেছেন, ইতোমধ্যে (হোসেনের কন্যা) বালিকা ফাতেমা পিতার মাথা দেখিয়া কাঁদিয়া আকুল হইল,শহরবানু তাহার জন্য সান্তনার উপায় খুঁজিতেই ছিলেন-ফাতেমার শ্বাসরোধহইল! ক্ষুধায় পিপাসায় কাতরা বালিকা কত সহিবে? হঠাৎ প্রাণত্যাগ করিল! শহরবানু এখন সকিনার অশ্রু মুছাইবেন, না ফাতেমাকে কোলে লইবেন? আহা! এত যে কেহই সহিতে পারিবে না! আমার শোকসন্তপ্তা পুত্র-শোকাতুরা ভগিনীগণ তোমরা একবার শহরবানু ও জয়নবের শোকরাশির দিকে দৃষ্টিপাত কর। তোমরা একজনের শোকেই বিহবল হও-দশদিক অন্ধকার দেখ! আরএ যে শোকসমূহ! আঘাতের উপর আঘাত। তোমরা এক সময় এক জনের বিরহে প্রাণ ভরিয়া কাঁদিতে পার, তাঁহাদের সে অবসর ছিল না!এক জয়নব কি করিবেন বল, নিজের পুত্রের জন্য কাঁদিবেন, না প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্রদের দিকে চাহিবেন, না সব ছাড়িয়া ভ্রাতা হোসেনের ক্ষত ললাটখানি অশ্রুধারায় ধুইবেন? সেখানে অশ্রু ব্যতীত আর জল ত ছিল না!বীরহৃদয়! একবার হোসেনেরবীরতা সহিষ্ণতা দেখ! ঐ দেখ, তিনি নদীবক্ষে দাঁড়াইয়া-আর কোন যোদ্ধা নাই, সকলে সমরশায়ী, এখন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা।তিনি কোন মতে পথ পরিস্ড়্গার করিয়া নদী পর্যন্ত গিয়াছেন। ঐ দেখ অঞ্জলি ভরিয়া জল তুলিলেন,বুঝি পান করেন; না, পান ত করিলেন না!-যে জলের জন্য আসগর তাঁহারই কোলে প্রাণ হারাইয়াছে, আকবর তাঁহার রসনা পর্যন্ত চুষিয়াছেন-সেই জল তিনি পান করিবেন? না,-তিনি জল তুলিয়া দেখিলেন, ইচ্ছা করিলে পান করিতে পারেন। কিন্তু তাহা না করিয়া নদীর জল নদীতেই নিক্ষেপ করিলেন! বীরের উপযুক্ত কাজ!! * মহরমের সময় সুন্নি-সম্প্রদায় শিয়াদলে আমোদের জন্য যোগ দেয় না। এ কথা যে বলে, তাহার ভুল,-শোচনীয় ভুল। আলী ও তদীয় বংশধরগণ উভয় সম্প্রদায়েরই মান্য ও আদরণীয়। তাঁহাদের শোচনীয় মৃত্যু স্মরণ সময়ে কোন প্রাণে সুন্নিগণ আমোদ করিবে? আমোদ করে বালকদল, সহৃদয় সুন্নিদল মহরমকে উৎসব বলে না। শিয়াদের বাহ্য আড়ম্বর সুন্নিগণ ভাল মনে করেন না। বক্ষে করাঘাত করিলে বা শোক-বস্ত্র পরিধান করিলেই যে শোক করা হইল, সুন্নিদের এরূপ বিশ্বাস নহে। মতভেদের কথা এই যে, শিয়াগণ হজরতা আয়ষা-ফাতেমার বিমাতা সিংহাসন আলীকে না দিয়া মোয়াবীয়াকে দিয়াছেন বলিয়া আয়ষাকে নিন্দা করে। আমরা আয়ষার (আলীর সৎশাশুড়ী হওয়া ব্যতীত আর) কোন দোষ দেখি না। চতুর্থ খলিফা কে হইবেন, ধর্ম্মগুরু মোহাম্মদ (দঃ) তাঁহার নাম স্পষ্ট না বলিয়া অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া দেখাইয়াছেন। সে নির্দ্দিষ্ট ব্যক্তি মোয়াবীয়া কিম্বা আলী তাঁহারা উভয়ে একই স্থানে দণ্ডায়মান ছিলেন। তাই মতভেদ হইল। কেহ বলিল “চতুর্থ খলিফা মোয়াবীয়া,” কেহ বলিল “আলী”। আয়ষা হিংসা করিয়া বলেন নাই, সিংহাসন মোয়াবীয়া পাইবেন। তিনি ঐ অনুমানের কথাই বলিয়াছিলেন মাত্র। সুন্নিগণ মাননীয়া আয়ষার নিন্দা সহ্য করিতে পারেন না। শিয়া সুন্নিতে এইটুকু কথার মতভেদ। এই বিষয় লইয়াই দলাদলি।
স্ত্রীজাতির অবনতি
পাঠিকাগণ! আপনারা কি কোন দিন আপনাদের দুর্দ্দশার বিষয় চিন্তা করিয়া দেখিয়াছেন? এই বিংশ শতাব্দীর সভ্যজগতে আমরা কি? দাসী! পৃথিবী হইতে দাস ব্যবসায় উঠিয়া গিয়াছে শুনিতে পাই, কিন্তু আমাদের দাসত্ব গিয়াছে কি? না। আমরা দাসীকেন?-কারণ আছে। আদিমকালের ইতিহাস কেহই জানে না বটে; তবু মনে হয় যে পুরাকালে যখন সভ্যতা ছিল না সমাজবন্ধন ছিল না,তখন আমাদের অবস্থা এরূপ ছিল না। কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ মানবজাতির এক অংশ (নর) যেমন ক্রমে নানাবিষয়ে উন্নতি করিতে লাগিল, অপর অংশ (নারী) তাহার সঙ্গে সঙ্গে সেরূপ উন্নতি করিতে পারিল না বলিয়া পুরুষের সহচরী বা সহধর্মিনী না হইয়া দাসী হইয়া পড়িল। আমাদের এ বিশ্বব্যাপী অধঃপতনের কারণ কেহ বলিতে পারেন কি? সম্ভবতঃ সুযোগের অভাব ইহার প্রধান কারণ। স্ত্রীজাতিসুবিধা না পাইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য্য হইতে অবসর লইয়াছে। এবং ইহাদিগকে অম ও অকর্ম্মণ্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য করিতে আরম্ভ করিল! ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশী সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকর্ম্মণ্য হইতে লাগিল। এদেশের ভিক্ষুদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে। একদিকে ধনাঢ্য দানবীরগণ ধর্ম্মোদ্দেশ্যে যতই দান করিতেছেন, অন্যদিকে ততই অধম ভিক্ষুসংখ্যা বাড়িতেছে! ক্রমে ভিক্ষাবৃত্তি অলসদের একটা উপজীবিকা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন আর তাহারা ভিক্ষা গ্রহণ করাটা লজ্জাজনক বোধ করে না।ঐরূপ আমাদের আত্মাদর লোপ পাওয়ায় আমরাও অনুগ্রহ আর সঙ্কোচ বোধ করি না। সুতরাং আমরা আলস্যের,-প্রকারান্তরে পুরুষের-দাসী হইয়াছি। ক্রমশঃ আমাদের মন পর্যন্ত দাস (enslaved) হইয়া গিয়াছে। এবং আমরা বহু কাল হইতে দাসীপনা করিতে করিতে দাসত্বে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছি। এইরূপে আমাদের স্বাবলম্বন, সাহস প্রভৃতি মানসিক উচ্চবৃত্তিগুলি অনুশীলন অভাবে বারবার অঙ্কুরে বিনাশ হওয়ায় এখন আর বোধ হয় অঙ্কুরিতও হয় না। কাজেই পুরুষজাতি বলিতে সুবিধা পাইয়াছেনঃ “The five worst maladies that afflict the female mind are :indocility, discontent, slander, jealousy and silliness … such is the stupidity of her character, that it is incumbent on her, in every particular, to distrust herself and to obey her husband.”(Japan, the Land of the Rising Sun) (ভাবার্থ-স্ত্রীজাতির অন্তঃকরণের পাঁচটি দুরারোগ্য ব্যাধি এই-(কোন বিষয় শিক্ষার) অযোগ্যতা, অসন্তোষ, পরনিন্দা, হিংসা এবং মুর্খতা। ···নির্ব্বোধ স্ত্রীলোকের কর্ত্তব্য যে প্রত্যেক বিষয়ে নিজেকে অবিশ্বাস করিয়া স্বামীর আদেশ পালন করে)। তারপর কেহ বলেন “অতিরঞ্জন ও মিথ্যা বচর রমণী-জিহবার অলঙ্কার!” আমাদিগকে কেহ “নাকেস-উল-আকেল” এবং কেহ “যুক্তিজ্ঞানহীন” (unreasonable) বলিয়া থাকেন। আমাদের ঐ সকল দোষআছে বলিয়া তাঁহারা আমাদিগকে হেয় জ্ঞান করিতে লাগিলেন। এরূপ হওয়া স্বাভাবিক। একটা উদাহরণ দেখুন। এদেশে জামাতা খুব আদরণীয়-এমনকিডাইনীও জামাই ভালবাসে। তবু “ঘরজামাইয়ের” সেরূপ আদর হয় না। তাই দেখা যায়, আমাদের যখন স্বাধীনতা ও অধীনতাজ্ঞান বা উন্নতি ও অবনতির যে প্রভেদ তাহা বুঝিবার সামর্থ্যটুকুও থাকিল না, তখন কাজেই তাঁহারা ভূস্বামী, গৃহস্বামী প্রভৃতি হইতে ক্রমে আমাদের “স্বামী” হইয়া উঠিলেন! আর আমরা ক্রমশঃ তাঁহাদের গৃহপালিত পশু পীর অন্তর্গত অথবা মূল্যবান সম্পত্তি বিশেষ হইয়া পড়িয়াছি!সভ্যতা ও সমাজবন্ধনের সৃষ্টি হইলে পর সামাজিক নিয়মগুলি অবশ্য সমাজপতিদের মনোমত হইল! ইহাও স্বাভাবিক। “জোর যার মুলুক তা”। এখন জিজ্ঞাসা করি, আমাদের অবনতির জন্য কে দোষী? আর এই যে আমাদের অতিপ্রিয়অলঙ্কারগুলি-এগুলি দাসত্বের নিদর্শন বিশেষ!এখন ইহা সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের আশায় ব্যবহার করা হয় বটে;কিন্তু অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তির মতে অলংকার দাসত্বের নিদর্শন (originally badges of slavery) ছিল। তাই দেখা যায় কারগারে বন্দীগণ পায় লৌহনির্ম্মিত বেড়ী পরে, আমরা (আদরের জিনিষ হাতকড়ী স্বর্ণ বা রৌপ্য-নির্ম্মিত চুড়ি! বলা বাহুল্য, লোহার বালাও বাদ দেওয়া হয় না! কুকুরের গলে যে গলাবদ্ধ (dogcollar) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্ম্মিত হইয়াছে! অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহ-শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণ-শৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া মনে করি “হায় পরিয়াছি”। গো-স্বামী বলদের নাসিকাবিদ্ধ করিয়া “নাকাদড়ী” পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে “নোলক” পরাইয়াছেন!! ঐ নোলক হইতেছে “স্বামী”র অস্তিত্বের (সধবার) নিদর্শন! অতত্রব দেখিলেনভগিনি! আপনাদের ঐ বহুমূল্য অলঙ্কারগুলি দাসত্বের নিদর্শন ব্যতীতআর কি হইতে পারে? আবার মজা দেখুন, তাঁহার শরীরে দাসত্বের নিদর্শন যত অধিক, তিনি সমাজে ততোধিকমান্যা গণ্যা!
এই অলঙ্কারের জন্য ললনাকুলের কত আগ্রহ! যেন জীবনের সুখ সমৃদ্ধি উহারই উপর নির্ভর করে! তাই দরিদ্রা! কামিনীগণ স্বর্ণরোপ্যের হাতকড়ী না পাইয়া কাচের চুড়ি পরিয়া দাসী-জীন সার্থক করে। যে (বিধবা) চুড়ি পরিতে অধিকারিণী নহে, তাহার মত হতভাগিনী যেন এ জগতে আর নাই! অভ্যাসের কিঅপার মাহিমা! দাসত্বে অভ্যাস হইয়াছে বলিয়া দাসত্বসূচত গহনাও ভাল লাগে। অহিফেন তিক্ত হইলেও আফিংচির অতি প্রিয় সামগ্রী। মাদক দ্রব্যে যতই সর্ব্বনাশ হউক না কেন, মাতাল তাহা ছাড়িতে চাহে না। সেইরূপ আমরা অঙ্গে দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিয়াও আপনাকে গৌরবান্বিতা মনে করি-গর্ব্বে স্ফীতা হই!
অলঙ্কার সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, তাহাতে কোন কোনভগ্নী আমাকে পুরুষপক্ষেরই গুপ্তচর মনে করিতে পারেন। অর্থাৎ ভাবিলেন যে, আমি পুরুষদেরটাকা স্বর্ণকারের হস্ত হইতে রক্ষা করিবার জন্য হয়ত এরূপ কৌশলে ভগ্নীদিগকে অলঙ্কারে বীতশ্রদ্ধ করিতে চেষ্টা করিতেছি। কিন্তু তাহা নয়,আমি আপনাদের জন্যই দু’কথাবলিতে চাই। যদি অলঙ্কারের উদ্দেশ্য পুরুষদের টাকার শ্রাদ্ধ করাই হয়, তবে টাকার শ্রাদ্ধ করিবার অনেক উপায় আছে দুই একটি উপায় বলিয়া দিতেছি।
আপনার ঐ জড়োয়া বাড়ীর আদুরে কুকুরটির কণ্ঠে পরাইবেন। আপনি যখন শকটারোহণে বেড়াইতে যান, তখন সেই শকটবাহী অশ্বের গলে আপনার বহুমূল্য হার পরাইতে পারেন! বালা ও চুড়িগুলি বসিবার ঘরের পর্দ্দার কড়া (drawing room Gi curtain ring) রূপে ব্যবহার করা যাইতে পারে। তবেই “স্বামী” নামধারী নরবরের টাকার বেশ শ্রাদ্ধ হইবে!! অলঙ্কারের মুখ্য উদ্দেশ্য ঐশ্বর্য্য দেখান বই ত নয়। ঐরূপে ঐশ্বর্য্য দেখাইবেন। নিজের শরীরের দাসত্বের নিদর্শন ধারণ করিবেন কেন? উক্ত প্রকারে গহনার সদ্ব্যবহার করিলে প্রথম প্রথম লোকে আপনাকে পাগল বলিবে, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য না করিলেই চলিবে। এ পোড়া সংসারে কোন ভাল কাজটা বিনা কেশেসম্পাদিত হইয়াছে? “পৃথিবীর গতি আছে” এই কথাবলাতে মহাত্ম গ্যালিলও (Galileo) কে বাতুলাগারে যাইতে হইয়াছিল। কোন সাধুলোকটি অনায়াসে নিজ বক্তব্য বলিতে পারিয়াছেন? তাই বলি, সমাজের কথায় কর্ণপাত করিবেন না। এ জগতে ভাল কথা বা ভাল কাজের বর্ত্তমানে আদর হয় না।বাস্তবিক অলঙ্কার দাসত্বের নিদর্শন ভিন্ন আর কিছুই নহে। যদি অলঙ্কারকে দাসত্বের নিদর্শন না ভাবিয়া সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের উপায় মনে করা যায়, তাহাই কি কম নিন্দনীয়? সৌন্দর্য্যবর্দ্ধনের চেষ্টাও কি মানসিক দুর্ব্বলতা নহে? পুরুষেরা ইহা পরাজয়ের নিদর্শন ভাবেন। তাঁহারা কোন বিষয় তর্ক করিতে গেলে বলেন, “আমার কথা প্রমাণিত করিতে না পারিলে আমি চুড়ি পরিব”! কবিবর সা’দী পুরুষদের উৎসাহিত করিবার জন্য বলিয়াছেন, “আয় মরদাঁ বকুশিদ্‌, জামা-এ-জানাঁ নপুষিদ্‌”! অর্থাৎ “হে বীরগণ! (জয়ী হইতে) চেষ্টাকর, রমণীর পোষাক পরিও না।” আমাদের পোষাক পরিলে তাহাদের অপমান হয়! দেখা যাউক সে পোষকটা কি,-কাপড় ত তাঁহাদের ও আমাদের প্রায় একই প্রকার। একখণ্ড ধূতি ও একখণ্ড সাড়ির দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে কিছুমাত্র তারতম্য আছে কি? যে দেশে পুরুষ পা-জামা পরে, সে দেশে নারীও পা-জামা পরে। “Ladies’s jacket” শুনা যায়, “Gentlemen’s jacket” ও শুনিতে পাই! তবে “জামা-এ-জানাঁ” বলিলে কাপড় না বুঝাইয়া সম্ভবতঃ রমণীসুলভ দুর্ব্বলতা বুঝায়।
পুরুষজাতি বলেন যে, তাঁহার আমাদিগকে “বুকের ভিতর বুক পাতিয়া বুক দিয়াঢাকিয়া” রাখিয়াছেন, এবং এরূপ সোহাগ আমরা সংসারে পাইব না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সোহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি! ফলতঃ তাঁহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন, তাহাতেই আমাদের সর্ব্বনাশ হইতেছে। আমাদিগকে তাঁহারা হৃদয়-পিঞ্জরে আবদ্ধ করিয়া জ্ঞান-সূর্যালোক ও বিশুদ্ধ বায়ু হইতে বঞ্চিতা রাখিয়াছেন, তাহাতেই আমরা ক্রমশঃ মরিতেছি। তাঁহারাআরও বলেন, “তাহাদের সুখেরসামগ্রী, আমরা মাথায় বহিয়া আনিয়া দিব-আমরা থাকিতে তাহারা দুঃখ সহ্য করিবে কেন?” আমরা ঐ শ্রেণীর বক্তাকে তাঁহাদের অনুগ্রহপূর্ণ উক্তির জন্য ধন্যবাদ দিই;কিন্তুু ভ্রাতঃ! পোড়া সংসারটা কেবল কবির সুখময়ী কল্পনা নহে-ইহা জটিল কুটিল কঠোর সংসার! সত্য বস্তু-কবিতা নহেঃ
“কাব্য উপন্যাস নহে-এ মম জীবন,
নাট্যশালা নহে-ইহা প্রকৃত ভবন”-
তাই যা কিছু মুস্কিল!! নতুবা আপনাদের কৃপায় আমাদের কোন অভাব হইত না।বঙ্গবালা আপনাদের কল্পিতবর্ণনা অনুসারে “ক্ষীণাঙ্গী, কোমলাঙ্গী, অবলা, ভয়-বিহবলা-” ইত্যাদি হইতে হইতে ক্রমে সূক্ষ্ম শরীর (Aerial body) প্রাপ্ত হইয়া বাস্পরূপে অনায়াসে আকাশে বিলীন হইতে পারিতেন!! কিন্তু প্রকৃত অবস্থা তদ্রুপ সুখের নহে; তাই এখন মিনতিকরিয়া বলিতে চাইঃ
“অনুগ্রহ করে এই কর, অনুগ্রহ কর না মোদের।”
বাস্তবিক অত্যধিক যত্নে অনেক বস্তু নষ্ট হয়। যে কাপড় বহু যত্নে বন্ধ করিয়া রাখা যায়, তাহা উইএর ভোগ্য হয়। কবি বেশ বলিয়াছেনঃ “কেন নিবে গেল বাতি? আমি অধিক যতনে ঢেকেছিনু তারে, জাগিয়া বাসর রাতি, তাই নিবে গেল বাতি।” সুতরাং দেখা যায়, তাঁহাদের অধিক যত্নই আমাদের সর্ব্বনাশের কারণ। বিপৎসঙ্কুল সংসার হইতে সর্ব্বদা সুরতিা আছি বলিয়া আমরা সাহস, ভরসা, বলএকেবারে হারাইয়াছি। আত্মনির্ভর ছাড়িয়া স্বামীদের নিতান্ত মুখাপেক্ষী হইয়া পড়িয়াছি। সামান্য হইতে সামান্যতর বিপদে পড়িলে আমরা গৃহকোণে লুকাইয়া গগনভেদী আর্ত্তনাদে রোদন করিয়া থাকি!! ভ্রাতৃমহোদয়গণ আবার আমাদের “নাকি কান্নার” কথা তুলিয়া কেমন বিদ্রূপ করেন, তাহা কে না জানে? আর সে বিদ্রূপের নীরবে সহ্য করি। আমরা কেমন শোচনীয়রূপে ভীরু হইয়া পড়িয়াছি, <তাহা ভাবিলে ঘৃণায় লজ্জায় মৃতপ্রায় হই। ব্যাঘ্র ভল্লুক ও দূরে থাকুক, আরসুলা জলৌকা প্রভৃতি কীট পতঙ্গ দেখিয়া আমরা ভীতিবিহবলা হই! এমনকি অনেকে মূর্চ্ছিতা হন! একটি ৯/১০বৎসরের বালক বোতলে আবদ্ধ একটি জলৌকা লইয়া বাড়ীশুদ্ধ স্ত্রীলোকদের ভীতি উৎপাদন করিয়া আমোদ ভোগ করে। অবলাগণ চীৎকার দৌড়িতে থাকেন, আর বালকটিসহাস্যে বোতল হস্তে তাঁহাদের পশ্চাৎ ধাবিত হয়। এমন তামাসা আপনারা দেখেন নাই কি? আমি দেখিয়াছি-আর সে কথা ভাবিয়া ঘৃণায় লজ্জায় মরমে মরিতেছি। সত্য কথা বলিতে কি, সে সময় বরং আমোদ বোধ করিয়াছিলাম; কিন্তু এখন সে কথা ভাবিলেশোণিত উত্তপ্ত হয়। হায়! আমরা শারীরিক বল, মানসিক সাহস, সব কাহার চরণে উৎসর্গ করিয়াছি? আর এই দারুণ শোচনীয় অবস্থা চিন্তা করিবার শক্তিও আমাদের নাই।ভীরুতার চিত্র ত দেখাইলাম, এখন শারীরিক দুর্ব্বলতার চিত্র দেখাইব। আমরা এমন জড় “অচেতন পদার্থ” হইয়া গিয়াছি যে, তাঁহাদের গৃহসজ্জা (drawing room এর ornament) বইআর কিছুই নহি। পাঠিকা! আপনি কখন বেহারের কোন ধনী মুসলমান ঘরের বউ-ঝী নামধেয় জড়পদার্থ দেখিয়াছেন কি? একটি বধূবেগম সাহেবার প্রতিকৃতি দেখাই। ইহাকে কোন প্রসিদ্ধ যাদুঘরে (museum এ) বসাইয়অ রাখিলে রমণীজাতির প্রতি উপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনকরা হইত। একটা অন্ধকার কক্ষে দুইটি মাত্র দ্বার আছে, তাহার একটি রুদ্ধ এবং একটি মুক্ত থাকে। সুতরাং সেখানে (পর্দার অনুরোধে?) বিশুদ্ধ বায়ুও সূর্য্যরশ্মির প্রবেশ নিষেধ। ঐ কুঠরীতে পর্য্যঙ্কের পার্শ্বে যেরক্তবর্ণ বানাত মণ্ডিত তক্তপোষ আছে, তাহার উপর বহুবিধ স্বর্ণাঙ্কারে বিভূষিতা, তাম্বুলরাগে রঞ্জিতাধরা, প্রসন্নাননাযে জড় পুত্তলিকা দেখিতেছেন, উহাই দুলহিনবেগম (অর্থাৎ বেগমের পুত্রবধূ)”। ইহারসর্ব্বাঙ্গে ১০২৪০ টাকারঅলঙ্কার! শরীরের কোন অংশে কত ভরি সোণা বিরাজমান, তাহা সুস্পষ্টরূপে বলিয়া দেওয়া আবশ্যক মনে করি। ১। মাথায় (সিঁথির অলঙ্কার) অর্দ্ধ সের (৪০ ভরি)। ২। কর্ণে কিঞ্চিৎ অধিক এরপোয়া (২৫ ভরি)। ৩। কণ্ঠে দেড় সের (১২০ তোলা)। ৪। সুকোমল বাহুলতায় প্রায় দুই সের (১৫০ ভরি)। ৫। কটিদেশে প্রায় তিন পোয়া (৬৫ ভরি)। ৬। চরণযুগলে ঠিক তিন সের (২৪০ ভরি) স্বর্ণের বোঝা!! বেগমের নাকে যে নথ দুলিতেছে, উহার ব্যাস সার্দ্ধ চারি ইঞ্চি! পরিহিত পা-জামা বেচারা সলমা চুমকির কারুকার্য্যও বিবিধ প্রকারের জরির (গোটা পাট্রার) ভারে অবরত! আর পা-জামা ও দোপাট্রার (চাদরের) ভারে বেচারী বধূ ক্লান্ত! ঐরূপ আট সের স্বর্ণের বোঝা লইয়া নড়াচড়া অসম্ভব, সুতরাং হতভাগী বধূবেগম জড়পদার্থ না হইয়া কি করিবেন? সর্ব্বদাই তাঁহার মাথা ধরে; ইহার কারণ ত্রিবিধ- (১) সুচিক্কণ পাটী বসাইয়াকষিয়া কেশবিন্যাস, (২) বেণী ও সিঁথির উপর অলঙ্কারের বোঝা, (৩) অর্দ্ধেক মাথায় আটা সংযোগে আফশাঁ (রৌপ্যচূর্ণ) ও চুমকি বসান হইয়াছে; ভ্রযুগ চুমকি দ্বারা আচ্ছাদিত। এবং কপালে রাঙ্গের বর্ণের চাঁদ ও তারা আটা সংযোগে বসান হইয়াছে। শরীর যেমন জড়পিণ্ড, মন ততোধিক জড়।এই প্রকার জড়পিণ্ড হইয়া জীবন ধারণ করা বিড়ম্বনা মাত্র। কারণ কোনরূপ শারীরিক পরিশ্রম না করায় বেগমের স্বাস্থ্য একেবারে মাটী হয়। কক্ষ হইতে কক্ষান্তরে যাইতে তাঁহার চরণদ্বয় শ্রান্ত ক্লান্ত ও ব্যথিত হয়। বাহুদ্বয় সম্পূর্ণ অকর্ম্মণ্য। অজীর্ণ ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতি রোগ তাঁহার চিরসহচর। শরীরে স্ফূর্ত্তি না থাকিলে মনেও স্ফূর্ত্তি থাকে না। সুতরাং ইহাদের মন এবং মস্তিঙ্ক উভয়ই চিররোগী। এমন স্বাস্থ্যলইয়া চিররোগী জীবন বহন করা কেমন কষ্টকর তাহা সকলেই বুঝিতে পারেন। ঐ চিত্র দেখিলে কি মনে হয়? আমরা নিজের ও অপরের অবস্থা দেখিয়া শুনিয়া চিন্তা করিলে যে শিক্ষালাভ করি, ইহাই প্রকৃত ধর্ম্মোপদেশ। সময় সময় আমরা পাখী শাখী হইতে যে সদুপদেশ ও জ্ঞানলাভ করি, তাহা পুঁথিগত বিদ্যার অপেক্ষাশ্রেষ্ঠ। একটি আতার পতন দর্শনে মহাত্মা নিউটন যে জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন, সে জ্ঞান তৎকালীন কোন পুস্তকে ছিল না। ঐ বধূবেগমের অবস্থা চিন্তাকরিতে গিয়া আমি আমাদের সামাজিক অবস্থার এই চিত্র আঁকিতে সম হইলাম! যাহা হউক, আমি উক্ত বধূবেগমের জন্য বড় দুঃখিত হইলাম, ভাবিলাম, “অভাগীর ইহলোক পরলোক-উভয়ই নষ্ট।” যদি ঈশ্বর হিসাব নিকাশ লয়েন যে, “তোমার মন, মস্তিঙ্ক, চক্ষু প্রভৃতির কি সদ্ব্যবহার করিয়াছ?” তাহার উত্তরে বেগম কি বলিবেন? আমি তখন সেই বাড়ীর একটি মেয়েকে বলিলাম, “তুমি যে হস্তপদদ্বারা কোন পরিশ্রম কর না, এজন্য খোদার নিকট কি জওবাবাদিহি (explanation) দিবে? সে বলিল, “আপকা কহনা ঠিক হ্যায়”-এবং সে যে সময় নষ্ট করে না, সতত চলা-ফেরা করে, আমাকে ইহাওজানাইল। আমি পুনরায় বলিলাম, “শুধু ঘুরা ফেরা কথাটার উত্তরে হাসির একটা গররা উঠিল। আমি কিন্তু ব্যথিত হইলাম, ভাবিলাম, “উল্টা বুঝলি রাম!” কোন বিষয়ে জ্ঞানলাভ করিবার শক্তিটুকুও ইহাদের নাই। আমাদের উন্নতির আশা বহুদূরে-ভরসা কেবল পতিতপাবন।
আমাদের শয়নকক্ষে যেমন সূর্য্যালোক প্রবেশ করেনা, তদ্রূপ মনোকক্ষেও জ্ঞানের আলোক প্রবেশ করিতে পায় না। যেহেতু আমাদের উপযুক্ত স্কুল কলেজ একপ্রকার নাই। পুরুষ যত ইচ্ছা অধ্যয়ন করিতে পারেন-কিন্তু আমাদের নিমিত্ত জ্ঞানরূপসুধাভাণ্ডারের দ্বার কখনও সম্পূর্ণ রূপে উন্মুক্ত হইবে কি? যদি কোন উদারচেতা মহাত্মা দয়া করিয়া আমাদের হাত ধরিয়া তুলিতে অগ্রসর হন, তাহা হইলে সহস্র জনে বাধাবিঘ্ন উপস্থিত করেন।
সহস্র জনের বাধা ঠেলিয়া অগ্রসর হওয়া একজনের কার্য্য নহে। তাই একটু আশার আলোক দীপ্তি পাইতে না পাইতে চির নিরাশার অন্ধকারে বিলীন হয়। স্ত্রীশিক্ষার বিরুদ্ধে অধিকাংশ লোকের কেমন একটা কুসংস্কার আছে যে তাঁহারা “স্ত্রীশিক্ষা” শব্দ শুনিলেই “শিক্ষার কুফলের” একটা ভাবী বিভীষিকা দেখিয়া শিহরিয়াউঠেন। অশিক্ষিত স্ত্রীলোকের শত দোষ সমাজ অম্লানবদনে মাফ করিয়া থাকে, কিন্তু সামান্য শিক্ষাপ্রাপ্তা মহিলা দোষ না করিলেও সমাজ কোন কল্পিত দোষ শতগুণ বাড়াইয়া সে বেচারীর ঐ “শিক্ষার” ঘাড়ে চাপাইয়া দেয় এবং শত কণ্ঠে সমস্বরে বলিয়া থাকে “স্ত্রীশিক্ষাকে নমস্কার”!
আজি কালি অধিকাংশ লোকে শিক্ষাকে কেবল চাকরী লাভের পথ মনে করে। মহিলাগণের চাকরী গ্রহণ অসম্ভব সুতরাং এই সকল চক্ষে স্ত্রীশিক্ষা সম্পূর্ণ অনাবশ্যক।
ফাঁকা তর্কের অনুরোধে আবার কোন নেটীভ খ্রীষ্টিয়ান হয়ত মনে করিবেন যে রমণীয় জ্ঞান-পিপাসাই মানবজাতির কারল!যেহেতু শাস্ত্রে (Genesis এ) দেখা যায়, আদিমাতা হাভা (Eve) জ্ঞানবৃক্ষের ফলভক্ষণ করিয়াছিলেন বলিয়া তিনি এবং আদম উভয়েই স্বর্গচ্যুত হইয়াছেন।
যাহা হউক “শিক্ষা”র অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষ “অন্ধ-অনুকরণ”নহে। ঈশ্বর যে স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা (faculty) দিয়াছেন, সেই মতাকে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি (develop) করাই শিক্ষা। ঐগুণের সদ্ব্যবহার করা কর্ত্তব্য এবং অপব্যবহারকরা দোষ। ঈশ্বর আমাদিগকে হস্ত পদ, কর্ণ, মনঃ এবং চিন্তাশক্তি দিয়াছেন। যদি আমরা অনুশীলন দ্বারা হস্তপদ সবল করি, হস্ত, দ্বারা সৎকার্য্য করি, চক্ষুদ্বারা মনোযোগ সহকারে দর্শন (বা observe) করি, কর্ণ দ্বারা মনোযোগ পূর্ব্বক শ্রবণ করি, এবং চিন্তাশক্তি দ্বারা আরও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করিতে শিখি-তাহাই প্রকৃতশিক্ষা। আমরা কেবল “পাশ করা বিদ্যা”কে প্রকৃত শিক্ষা বলি না। দর্শনশক্তির বৃদ্ধি বা বিকাশ সম্বন্ধে একটা উদাহরণ দিতেছিঃযেখানে অশিক্ষিত চক্ষু ধূলি, কর্দ্দম ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পায় না, সেখানে (বিজ্ঞানের) শিক্ষিত চক্ষু অনেক মনোরম চমৎকার বস্তু দেখিতে পায়। আমাদের পদদলিত করি, বিজ্ঞানবিদ্‌ তাহা বিশ্লিষ্ট করিলে নিন্মলিখিত বস্তু চতুষ্টয় প্রাপ্ত হইবেন। যথা-বালুকা বিশেষণ করিলেসাদা পাথর বিশেষ (opal); কর্দ্দম পৃথক করিলে চিনে বাসন প্রস্তুত করণোপযোগী মৃত্তিকা, অথবা নীলকান্তমণি; পাথর-কয়লার কালি দ্বারা হীরক! এবং জল দ্বারা একবিন্দু নীহার! দেখিলেন,ভগিনী! সেখানে অশিক্ষিত চক্ষু কর্দ্দম দেখে, সেখানে শিক্ষিত চক্ষু হীরা মাণিক দেখে! আমরা যেএহেন চক্ষুকে চির-অন্ধ করিয়া রাখি, এজন্য খোদারনিকট কি উত্তর দিব?
মনে করুন আপনার দাসীকে আপনি একটা সম্মার্জ্জনী দিয়া বলিলেন, “যা, আমার অমুক বাড়ী পরিস্কার রাখিস্‌”। দাসী সম্মার্জ্জনীটা আপনার দান মনে করিয়া অতি যত্নে জরির ওয়াড়ে ঢাকিয়া উচ্চস্থানে তুলিয়া রাখিল-কোন কালে ব্যবহারকরিল না। এদিকে আপনার বাড়ী ক্রমে আবর্জ্জনাপূর্ণ হইয়া বাসের অযোগ্য হইল! অতঃপর আপনি যখন দাসীর কার্য্যের হিসাব লইবেন, তখন বাড়ীর দুরবস্থা দেখিয়া আপনার মনে কি হইবে? শতমুখী ব্যবহার করিয়া বাড়ী পরিস্কার রাখিলে আপনি খুসী হইবেন, না তাহার প্রতি ভক্তি প্রদর্শন করিলে সন্তুষ্টহইবেন?বিবেক আমাদিগকে আমাদের প্রকৃত অবনতি দেখাইয়া দিতেছে-এখন উন্নতির চেষ্টা করা আমাদের কর্ত্তব্য।
আমাদের উচিত যে স্বহস্তে উন্নতির দ্বার উন্মুক্ত করি। এক স্থলে আমি বলিয়াছি “ভরসা কেবল পতিতপাবন” কিন্তু ইহাও স্মরণ রাখা উচিত যে, ঊর্দ্ধে হস্ত উত্তোলন না করিলে পতিতপাবনও হাত ধরিয়া তুলিবেন না। ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করেন যে নিজে নিজের সাহায্য করে, (“God helps those that help themselves”তাই বলি আমাদের অবস্থা আমরা চিন্তা না করিলে আর কেহ আমাদের জন্য ভাবিবে না। ভাবিলেও তাহাতে আমাদের ষোল আনা উপকার হইবে না।
অনেকে মনে করেন যে পুরুষের উপার্জ্জিত ধন ভোগ করে বলিয়া নারী তাহার প্রভুত্ব সহ্য করে। কথাটা অনেক পরিমাণে ঠিক। বোধ হয় স্ত্রীজাতি প্রথমে শারীরিক শ্রমে অম হইয়া পরের উপার্জ্জিত ধনভোগে বাধ্য হয়। এবং সেইজন্য তাহাকে মস্তক নত করিতে হয়। কিন্তুু এখন স্ত্রীজাতির মন পর্য্যন্ত দাস (enslaved) হওয়ায় দেখা যায়, যে স্থলে দরিদ্র স্ত্রীলোকেরা সূচিকর্ম্ম বা দাসীবৃত্তি দ্বারা অর্থ উপার্জ্জন করিয়া পতি পুত্র প্রতিপালন করে, সেখানেও ঐ অকর্ম্মণ্য পুরুষেরাই “স্বামী” থাকে। আবার যিনি স্বয়ং উপার্জ্জন না করিয়া প্রভূত সম্পত্তির উত্তরাধিকারিণীকে বিবাহ করেন, তিনিও ত স্ত্রীর উপর প্রভুত্ব করেন! এবং স্ত্রী তাহাঁর প্রভুত্বেআপত্তি করেন না। ইহার কারণ এই যে বহুকাল হইতে নারীহৃদয়ের উচ্চবৃত্তিগলি অঙ্কুরে বিনষ্ট হওয়ায় নারীর অন্তর, বাহির মস্তিঙ্ক, হৃদয় সবই “দাসী” হইয়া পড়িয়াছে। এখন আর আমাদের হৃদয়ে স্বাধীনতা, ওজস্বিতা বলিয়া কোন বস্তু নাই-এবং তাহা লাভ করিবার প্রবৃত্তি পর্য্যন্ত লক্ষিত হয় না! তাই বলিতে চাইঃ
“অতএব জাগ, জাগ গো ভগিনি!”
প্রথমে জাগিয়া উঠা সহজ নহে, জানি; সমাজ মহা গোলযোগ বাধাইবে জানি; ভারতবাসী মুসলমান আমাদেরজন্য “কৎল” এর (অর্থাৎ প্রাণদণ্ডের) বিধান দিবেন এবং হিন্দু চিতানল বা তুষানলের ব্যবস্থা দিবেন, জানি! (অর্থাৎ ভগ্নিদিগেরও জাগিবার ইচ্ছা নাই, জানি!) কিন্তু সমাজের কল্যাণের নিমিত্তজাগিতে হইবেই। বলিয়াছি ত কোন ভাল কাজ অনায়াসে করাযায় না। কারামুক্ত হইয়াও গ্যালিলিও বলিয়াছিলেন, কিন্তু যাহাই হউক পৃথিবী ঘুরিতেছে (“but nevertheless it (Earth) does move”)!! আমাদিগকেও ঐরূপ বিবিধ নির্যাতন সহ্য করিয়া জাগিতে হইবে। এস্থলে পার্সী নারীদের একটি উদাহরণ দিতেছি। নিন্মলিখিত কতিপয় পংক্তিএক খণ্ড উর্দ্দু সংবাদপত্র হইতে অনূদিত হইলঃ
এই পঞ্চাশ বর্ষের মধ্যে পার্সী মহিলাদের অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে। বিলাতী সভ্যতা, যাহা তাঁহারা এখন লাভ করিয়াছেন, পূর্ব্বে ইহার নাম মাত্র জানিতেন না। মুসলমানদের ন্যায় তাঁহারাও পর্দায় (অর্থাৎঅন্তঃপুরে) থাকিতেন। রৌদ্র ও বৃষ্টি হইতে রক্ষা পাইবার নিমিত্ত তাঁহারা ছত্র ব্যবহারে অধিকারিণী ছিলেন না। প্রখর রবির উত্তাপ পর্দা থাকিত। অন্যের জুতাই ছত্ররূপে ব্যবহার করিতেন!! গাড়ীর ভিতর বসিলেও তাহাতে পর্দা থাকিত। অন্যের সম্মুখে স্বামীর সহিত আলাপ করিতে পাইতেন না। কিন্তু আজিকালি পার্সী মহিলাগণ পর্দা ছাড়িয়াছেন! খোলা গাড়ীতে বেড়াইয়া থাকেন। অন্যান্য পুরুষের সহিত আলাপ করেন। নিজেরা ব্যবসায় (দোকানদারী) করেন। প্রথমে যখন কতিপয় ভদ্রলোক তাঁহাদের স্ত্রীকে (পর্দার) বাহির করিয়াছিলেন, তখন চারিদিকে ভীষণ কলরব উঠিয়াছিল। ধবলকেশ বুদ্ধিমানগণ বলিয়াছেন, “পৃথিবীর ধ্বংসকাল উপস্থিত হইল”। কই পৃথিবী ও ধ্বংস হয় নাই। তাই বলি, একবার একই সঙ্গে সকলে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হও,-সময়ে সবই সহিয়া যাইবে। স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে। এখন প্রশ্ন হইতে পারে, কিকরিলে লুপ্ত রত্ন উদ্ধার হইবে? কি করিলে আমরা দেশের উপযুক্ত কন্যা হইব? প্রথমতঃ সাংসারিক জীবনের পথে পুরুষের পাশাপাশি চলিবার ইচ্ছা অথবা দৃঢ় সংকল্প আবশ্যক। এবং আমরা গোলামজাতি নই, এই কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিতে হইবে।
||সমাপ্ত||

Polly po-cket